প্রকাশিত: Mon, Aug 21, 2023 2:21 PM
আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 8:42 PM

ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলার রেশ এবং রাজনীতির স্বাভাবিক গতিধারার মৃত্যু

মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাটি শুধু গণমানুষকে হত্যা করার জন্যই করা হয়নি, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করার জন্যও পরিচালিত হয়েছিলো। যেখানে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে বলে অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই হামলায় তিনটি জিনিসের সমন্বয় আমরা দেখতে পাই। রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং জঙ্গিসংগঠন। এই তিনটি দল মিলে হামলাটি করেছে। হামলাটি বন্ধ করার জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়েনি এবং হামলার পরে রাষ্ট্রের যে দায় আছে, জনগণের জীবন বাঁচানোর, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থাÑ সেগুলোও আমরা করতে দেখিনি। 

হামলাকারীরা কীভাবে স্টেজের কাছে আসতে পারলো হাতে গ্রেনেড নিয়ে, সেটি একটি প্রশ্নের জন্ম দেয় যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের এই জায়গাগুলো করে দেওয়া হয়েছিলো। হামলা পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যে পরিবেশের মধ্যে হামলাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে। তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কারণ একজন হামলাকারীও হামলার স্থান থেকে ধরা পড়েনি। ক্রাইম সিনে প্রমাণ নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব হলো নিরাপত্তা বাহিনীর। কিন্তু তারা পানি দিয়ে সেসব প্রমাণ ধুয়ে ফেলেছিলেন। অপরদিকে আমরা দেখেছি, জজ মিয়া নামে একটি নাটক সাজিয়ে নতুন সাক্ষ্য তৈরি করা হয়েছিলো। এই হামলা থেকে শুধু মানুষের মৃত্যুই ঘটেনি, রাজনীতির স্বাভাবিক গতিধারারও মৃত্যু ঘটেছিলো। রাজনীতিতে একটি চরম অনাস্থা এবং অবিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্প্রীতির রাজনীতি হিসেবে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। 

এই হামলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যদি আমরা খুঁজে দেখি, তাহলে আমরা দেখবোÑ হামলার মূল লক্ষ্য ছিলো, তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। কিন্তু ঘটনাক্রমে তারা সেখান থেকে বেঁচে যান। বেঁচে যাওয়ার পরেও শেখ হাসিনার গাড়িতে গুলি করা হয়। সেই সময়ের ঘটনা এবং ঘটনা পরবর্তী সময় যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যায় এর পেছনে রাজনীতি, রাষ্ট্রপৃষ্ঠপোষকতা কাজ করেছে এবং জঙ্গিদলকে ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা শুধু দেশের জনগণের নিরাপত্তাই নয়, রাষ্ট্রকে অত্যন্ত ভঙ্গুর করে তোলে এবং রাষ্ট্রকে অনিরাপদ করে তোলে। তাই এরকম হামলা বাংলাদেশে ভবিষ্যতে যাতে না হয়, সেজন্য বাংলাদেশের জনগণ এবং সকল রাজনৈতিক দলকে সতর্ক থাকতে হবে। এই হামলা যারা করিয়েছেন তাদের ভালোভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। যারা হামলা করেছেন, তাদের অনেকের বিচার হয়েছে। তাই তাদের উন্মুক্ত করা আগামী দিনের চলার পাথেয় হয়ে থাকবে এবং সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে। সেখানে যে লক্ষ্যবস্তু ছিলো, সেটি প্রতিপক্ষ রাজনীতিকে উৎপাটিত করার একটি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। সেখানে জঙ্গিরা ধর্মীয় দর্শন নিয়ে যে হামলা করে; তা ধর্মীয় দর্শনের সঙ্গে মেলানো যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। জঙ্গি বা অন্য যেকোনো হামলাকারী হোক তারা সহিংস, হত্যার রাজনীতি তৈরি করে এবং এটি দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই ক্ষতিকর পরিস্থীতি তৈরি করার জন্য আমরা দেখেছি, জঙ্গি দলকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই জঙ্গিবাদ বেড়ে ওঠার পেছনে আমরা দেখেছি, দুটি পৃষ্ঠপোষকতা কাজে লাগে। একটি হলো যারা জঙ্গিদলকে রাজনীতি সুরক্ষা দেয়, আরেকটি হলো জঙ্গিদলকে আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে দেশের ভেতর একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা। আরেকটি হলো, মানুষের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলা এবং ভয় দিয়ে জয় করার চেষ্টা। অর্থাৎ মানুষের স্বাধীনতা হরণ করতে চাওয়া ভয় দেখিয়ে। সেই জঙ্গির উত্থান যেখানে ঘটেছে সেখানেও আমরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেখেছি। যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিদলগুলো বেড়ে উঠেছিলো, পরবর্তী সময়ে যখন রাষ্ট্র জঙ্গিবাদের জন্য শূন্য সহিংসতা নীতি অনুসরণ করে তখন থেকে এবং হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে তারা অবদমিত হতে থাকে এবং সেই অবদমন এখনো চলমান আছে বলেই বাংলাদেশ এসকল কিছু থেকে নিরাপদ আছে, জননিরাপত্তা এবং মানুষের জান-মাল নিরাপদ রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখলে আমরা বুঝবো, এসব কিছু এখন সহনীয় পর্যায়ে আছে। 

জঙ্গিবাদের দুটি বিশেষ দিক আছে। একটি হলো জঙ্গিবাদী আর সহিংস দর্শন, আরেকটি হলো যেটি বাস করে মানুষের মস্তিষ্কে। অন্য একটি হলো যারা জঙ্গিদের প্রভাবিত করে তাদের হামলা করার জন্য সশস্ত্রভাবে তৈরি করা। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী জঙ্গিদের এই সশস্ত্রভাবে হামলা করার বিষয়টি খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ বা অবদমন করতে পেরেছেন। ফলে এই দেশ নিরাপদ হয়েছে। জঙ্গিবাদের যে সহিংস দর্শন, যেটি মস্তিষ্কে বাস করেÑ সেটি উৎপাটিত করা নিরাপত্তা বাহিনীর মূল কাজ নয়। এটি সমাজ ও রাজনীতির কাজ। জঙ্গিবাদের সহিংস দর্শন যতোক্ষণ না উৎপাটিত করে সেখানে সম্প্রতির দর্শন প্রতিস্থাপন করা যাবে, ততোদিন জঙ্গিবাদ বেড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা, সেটি জিয়িয়ে থাকবে। পরিচিতি: নিরাপত্তা বিশ্লেষক  

শ্রুতিলিখন : জান্নাতুল ফেরদৌস